মঙ্গলবার, ২২ জুলাই, ২০১৪

মিকি





আমি তখন ক্লাস নাইন এ পড়ি।আমার এক বন্ধু রাস্তা থেকে কুড়িয়ে একটা বেড়াল নিয়ে এলো । বললো, বেড়ালটা খুব দুখী। আমরা যেনো ওর ভরণ পোষণের ব্যবস্থা করি। হয়ে গেল কাজ।আমরা চার ভাই বোন কে আর পায় কে। শুধু আম্মার অনুমুতি বাকি।আব্বাকে  আম্মাই সামলে নেবে।বেড়াল পালবার প্রস্তাবের শুরুতেই আম্মা বললো ,এই পৃথিবীতে কেও যদি কাওকে শত্রু বানাতে চায় তবেই নাকি বেড়াল উপহার হিসেবে দেয়। কেবল একটা বেড়ালের মাধ্যমে নাকি যেকোনো বন্ধুত্ব ভেঙ্গে যেতে সক্ষম। বেড়াল এতই বিরক্তিকর প্রাণী।আম্মার কথাটা অবশ্য সত্যি হয়েছে। যাই হউক,আম্মার সব উপদেশ আমাদের  বেড়াল ভালবাসার কারণে একসময় ব্যর্থ হলো।
আমাদের কান্নাভেজা  চোখের দিকে  তাকিয়ে অবশেষে আম্মা রাজি হলেন।
এরপর আব্বার অশান্তির কথা নাই বা লিখলাম। আম্মা আর আব্বার চরম ভ্রু কুচকানো চেহারার সামনে সগর্বে বসত হলো মিকির।

যেখানেই মিকি যায় আব্বা বিরক্ত। ইলিশ মাছ কেনা বন্ধ। কারণ ইলিশের গন্ধ পেলে মিকি আর বেড়াল থাকেনা। মানুষ হয়ে যায়। টেবিল চেয়ার এ সম্মানের সাথে খাদ্য গ্রহণ করতে চায়। এরকম নানা অবস্থায় খাপ খাইয়ে মিকির জীবন চলতে থাকে।
মিকি অসাধারণ সুন্দরী হবার কারণে ধীরে ধীরে বাড়ীর আশেপাশে সকল বেড়াল ওর বন্ধুত্ব পেতে আগ্রহী হয়ে ওঠে।
তার ফলাফল স্বরূপ মিকি ১১ টি বাচ্চার জন্ম দেয় স্তরে স্তরে অর্থাৎ বছরে বছরে।
এবার শুরু হলো আসল যন্ত্রণা। আমরা কিছুতেই বাচ্চা গুলো কাওকে দেবোনা। সবাই মিলেমিশে থাকবো।আব্বার রক্তচক্ষু পুরোপুরি আম্মার উপর চাপিয়ে দিয়ে মিকি আর তার গোটা পরিবার এর দায়িত্ব নিলাম আমরা।

বেশ ভালই ছিলাম সবাই মিলে।ঋতু বদলাচ্ছে। সময় গড়াচ্ছে। মিকির বাচ্চারা বড় হচ্ছে। ওরই  রাজত্ব কারণ আমার মায়েরই তো এত ছানাপোনা নেই।
এমনি করতে করতে  শীতের এক মিষ্টি দুপুর। আমরা চার ভাই বোন একসাথে ঘুমাচ্ছি, লেপ মুড়ি দিয়ে ভীষন আরামের ঘুম। সাথে ১১ টি বেড়াল ছানা  আমাদের জড়িয়ে।
হঠাত ঘরে ঢুকলো আব্বা। আমরা যথাসম্ভব আব্বার কাছ থেকে মিকির পরিবার কে দুরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করতাম। কিন্তু এবার ধরা খেলাম। আব্বার সেকি রাগ। আমি বড় হয়ে যাওয়াতে মারতে পারছেনা। বাকিগুলা সমানে মার খাচ্ছে।
এই দৃশ্য দেখে কি হলো মিকির জানিনা। ও মনে মনে কি যেন প্রতিজ্ঞা করে ফেললো। ওই দিন থেকে শুরু হলো মিকির অদ্ভুত কার্যকলাপ। আব্বা যা করছে মিকি তাই করছে। শুধু কথা বলা ছাড়া আর সমস্ত কিছু সে আব্বার মতন করার চেষ্টা করছে। আব্বা আয়েশী চেয়ার এ বিশ্রাম নিতে গিয়ে দেখছে মিকি ওখানে আগের থেকেই আব্বার মতন করে শুয়ে আছে। একই ভাবে। মোদ্দা কথা আব্বা বাজার নিয়ে এলে মিকিও বাজার নিয়ে আসার মতন একটা ভঙ্গী করছে চার  পা দিয়ে । অদ্ভুত অবস্থা। আমরা কিছুতেই মিকির এইসব বেয়াদবি সামাল দিতে পারছিনা।
ঘরে ভয়াবহ অশান্তি। যথারীতি আম্মা একাই সব সামাল দিয়ে যাচ্ছে।
ভেবেছিলাম এমন করেই চলবে। তবুতো  মিকি আছে গোটা পরিবার সহ।
আমরা নিশ্চিন্তে কাজ করি ,ঘুমাই ,খাই দাই। জানতেই পাইনি আব্বা আর আম্মার মনে এই ছিলো।

একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি মিকিরা কেও নেই।সেকি ভয়াবহ অবস্থা আমাদের। কিছুদিন পর আমার বিয়ে। এই চরম আনন্দময়  মুহুর্তে আমার ভাইরা ভাবতেই পারছেনা মিকি নেই।মিকি কে ছাড়া আপার  বিয়ে।কিকরে সম্ভব। কিন্তু মিকি কোথায় ?কোথায় মিকি ?
তন্ন তন্ন করে খোঁজা হলো। পাওয়া গেলোনা।আমাদের সন্দেহ খুব স্বাভাবিক আব্বার দিকে। কিন্তু আব্বাও এত মর্মাহত ভাব করছে কিছু বোঝার উপায় থাকলোনা যে আব্বা নিজেই আমাদের বাবুর্চি কে সঙ্গে করে অনেক দূরে নদীর পারে মিকির পুরো পরিবার কে রেখে এসেছে। বাবুর্চি আঙ্কেল বহু দিন পর স্বীকার করেছিলেন বলেই জানতে পেরেছিলাম।

এরপর আমার বিয়ে হলো। মিকি নেই। আমি নেই। অসহনীয় কষ্ট আমার ভাইদের। কষ্ট করে করে ২০০৩ সাল। ১৩ ই জুলাই। এক সুন্দর সন্ধ্যায় জন্ম হলো আমার মেয়ের। আমার ভাইরা আগেই বলে রেখেছে  মেয়ে যদি হয় তবে মিকি ফিরে আসবে।কি অদ্ভুত ভালবাসা।এখনো ওরা আমার মেয়েকে বেড়াল ছানা ডাকে।এখনো ওদের কাছে আমার কন্যা মানে আমাদের মিকি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন