এসি চলছিলো। এতো ঠান্ডা হয়ে গেলো একসময় একটু শীত শীত করছিলো। বিছানায় শুয়েছিলাম। রোদ্দুর পাশে বসে টি ভি দেখছিলো।ওকে বললাম :"বাবা ,শীত করছে ,এ সি টা বন্ধ কর নয়তো একটা চাদর দাও। "রোদ্দুর আমার গায়ের ওপর লাফ দিয়ে শুয়ে পড়ে বললো :"এইত চাদর হয়ে গেলাম আমি। এখন কি আর শীত করে মা ?"
বাসার ল্যান্ড লাইন বৃষ্টি হলেই নষ্ট হয়ে যায়। তাই অদ্রী কে একটা সেল দেয়া
হয়েছে। আমার অনুপস্থিতিতে খবর রাখার জন্যে। আমার মেয়ে আবার আমি খবর পড়তে
গেলে ওই সেল থেকে আমাকে এস এম এস পাঠায় :মাম্মি ,আজকে তোমাকে দারুন লাগছে
,ইত্যাদি ইত্যাদি।এই দেখে রোদ্দুর খুব ঈর্ষান্বিত। সে রেগে মেগে আমাকে
টেক্সট করবেনা। বাবাকে করবে। আমি তবু ওকে শিখিয়ে দিচ্ছি কিভাবে লিখতে হয়। বললাম
:"বাবাকে I LOVE U লেখ। "কিছুতেই লিখছেনা। আবার বলছে ও না কেন লিখছেনা। অনেক জানতে চাওয়ার পর আমার ছেলের উত্তর :"I LOVE U তো শুধু তোমার জন্যে মা।"
রোদ্দুর পড়ে কে জি তে।আমার মেয়ের ছোটবেলার প্রথম শ্রেনীর বাংলা পাঠ্য বই কোত্থেকে যেন খুঁজে পেয়েছে।ওখানে বায়েজিদ বোস্তামী কে নিয়ে একটা অসাধারণ গল্প আছে। সাথে আঁকা ছবিও। বায়েজিদের ছোটবেলা। তিনি একগ্লাস পানি হাতে মায়ের মাথার শিয়রে দাঁড়িয়ে আছেন।
রোদ্দুর বলল :এই ছবির গল্পটা বল ".
গল্প টা সবাই জানে। বায়েজিদের মা অসুস্থ। তিনি পানি খেতে চাইলেন। বায়েজিদ অনেক দূরে ঝর্না থেকে পানি নিয়ে এসে দেখেন মা ঘুম। তিনি সারারাত ওই পানি নিয়ে মায়ের শিয়রে দাঁড়িয়ে রইলেন। সকালে মা ঘুম থেকে উঠে দেখলেন ছেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মায়ের ঘুম ভেঙ্গে যাবে বলে মা কে আর ডাকেনি। বায়েজিদের মা অভিভূত হয়ে তাঁকে অনেক দোয়া করলেন।
পুরো গল্প বলার ভেতর আমার ছেলে একটা প্রশ্ন ও করেনি। খুব মন দিয়ে শুনলো।
সব শুনে রোদ্দুর যে মতামত দিলো তা হলো :"মা ,বায়েজিদ তো মাকে ভালোই বাসেনা ।"
অবাক হয়ে জানতে চাইলাম :"কেনো বাবা?ও সারারাত ঘুমায়নি। মায়ের ঘুম ভেঙ্গে যাবে বলে মা কে ঘুম থেকে ডাকেনি। কতো লক্ষী ছেলে দেখ। "
রোদ্দুরের উত্তর :"মা,ওতো বুদ্ধু। সারারাত পানিটা নিয়ে দাঁড়িয়ে না থেকে পানিটা সিদ্ধ করে নিলেই হতো। ও ওর মা কে কাঁচা পানি খাওয়ালো মা ?তুমিতো বলেছো BAD BOY রা কাঁচা পানি খায়। ওতো BAD BOY."
বিশ্বকবির গালে হাত চিন্তিত মুখর ছবি দেখিয়ে বললাম :"বাবা,উনি আমাদের বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।"
রোদ্দুর বললো :মা,উনার দেখো মন খারাপ। একটা কবিতা লেখার পর আর লিখতে পারছেনা। তাই মিস বকা দেবে তাই উনি গালে হাত দিয়ে ভাবছেন।"
রোদ্দুর আর আমি প্রায়ই দোকান দোকান খেলি।আজকে ওর দোকানে আমি জিনিসপত্র
কিনতে আসছি। ওখানে আবার সবকিছু পাওয়া যায়।এবং অনেক সুবিধা আছে। একটা কিনলে
আরেকটা ফ্রি।
১)মোবাইল কিনলে হ্যান্ডস ফ্রি ফ্রি।
২)ড্রেসিং টেবিল কিনলে আয়না ফ্রি।
৩)টর্চ লাইট এর সাথে অন্ধকার ফ্রি।
৪)পর্দার সাথে জানালা ফ্রি।
৫)পাঞ্চ ক্লিপ এর সাথে চুল ফ্রি।
৬)বিছানার চাদরের সাথে খাট ফ্রি।
এতো ফ্রি জিনিসের ভিতর জানতে চাইলাম :"বাবা ,রোদ্দুর কে কিনলে কি পাওয়া যাবে ফ্রি ?"
ঝটপট উত্তর :"চশমা ফ্রি। "
আমাদের বাড়ীতে ৩ টে বাচ্চা। আমার ছেলে ,মেয়ে এবং তাদের বাবা। প্রত্যেকেই
অদ্ভুত।যেন আমার কোনো অসুখ করতে নেই। ওরা আমার অসুখ করলেই আমার চেয়ে বেশি
অসহায় হয়ে পড়ে।কিছুদিন হলো ভাইরাল জ্বর এ পড়লাম। তেমন কিছুনা।সামান্য।
চেষ্টা ছিলো রোদ্দুর কে একটু সামলে রাখার ওই ছোঁয়াচে জ্বরের থেকে।কারণ
রোদ্দুর সারাদিন রাতে আমায় প্রায় ৫০০ টা চুমু খায়।বাড়ীর অসহায় ৩ টে মানুষ
বেজার মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেখতেও খারাপ লাগছে। এমনি করেই রাত হলো। অনেক
রাত। আমার ঘুম আসছেনা। চোখ খুললেই দেখছি রোদ্দুর চোখ পিটপিট করছে। রাত ৩
টের দিকে ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম :'বাবা ,ভয় পাচ্ছো ?'ওই রাতে আবার ভূতের
সিনেমাও দেখেছি। নাম গয়নার বাক্স।
আমার ছেলের উত্তর :না ,মা ভয় পাচ্ছিনা তো।
তাহলে ঘুমোচ্ছো না কেনো বাবা ?মন খারাপ তোমার ?
ছেলে বললো :হুম মা।
কেনো ?
মা ,তুমি কখন সুস্থ হবে ?আমি কখন তোমার বুকে আসতে পারবো ?
এইতো বাবা ,আর মাত্র একদিন।
ছেলেটা তারপর বলে :"তুমি ভালো না থাকলে আমি কেমন করে ভালো থাকি মা ?"
ছুটির দিনে রোদ্দুর :বাবা বাসায় থাকাটা কিন্তু DISGUSTING মা।
:কেনোরে বাবা ?
:এই যে সারাক্ষণ তোমার সাথে গল্প করে। আর আমি তোমাকে মিস করি।
সবুজ দেখতে গিয়ে রোদ্দুরের প্রশ্ন :মা ,ড্রয়িং খাতার সবুজ ঘাস আর গাছ গুলো নাহয় আমরা দুজন মিলে আঁকি ,কিন্তু এখানের গাছ আর ঘাস কে এঁকেছে ?ওর রংতুলির বাক্স কোথায় ? আমি ওকে জিজ্ঞেস করবো ও এতো সুন্দর করে কি করে রং করে ?একটুও বর্ডার লাইন ক্রস করেনাতো ?
আমরা খুব ভালো একটা ছুটি কাটিয়েছিলাম আমার দাদার বাড়ীতে। আদরের এতোটাই
আতিশয্য ছিলো যে এই যান্ত্রিক শহরে ফিরে আসার পর আমার ছেলে বা মেয়ে
কোনভাবেই নিজেদের আর মানিয়ে নিতে পারছিলোনা। আজ নিয়ে বেশ কিছুদিন হলো আমরা ফিরেছি।ফেরার পর থেকে প্রায় প্রতিরাতে রোদ্দুর কাঁদে। ভয়ানক মিস করতে থাকে সবাইকে।আমার দাদা বাড়ী মানেই ওদের নানা বাড়ী। এবং অপরিসীম আনন্দ। কিন্তু যা বলতে নিয়ে এতো কিছু লেখার আয়োজন তা সম্পূর্ণ ভিন্ন।আমার ছেলেটা প্রতিরাতে
এভাবে কাঁদতে শুরু করে সেই ফেলে আশা আদর গুলোর জন্য,আর আমি কোনভাবেই ওকে
কাঁদতে দিইনা।একটা কিছু মজার গল্প বলে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করি। কিন্তু ভুল
টা আমার সেখানেই হলো। কালরাতে আমার ছেলে একটা অদ্ভুত কথা বললো :"মা ,কান্না খুব বেশি পেলে কাঁদতে দিও। নয়তো কান্না গুলো জমতে থাকে আর শেষ হয়না। প্রতিদিন কান্না আসে।একসাথে সব কান্না কেঁদে ফেললে আর কখনো কান্না আসবেনা মা। "
কি অদ্ভুত !!!!!!!!
হরতালের কারণে রোদ্দুরের স্কুল হয় এখন শুক্র আর শনিবারে।গতরাতে একটা
দাওয়াতে যাবার কারণে রাতের বেলা কিছু গুছিয়ে রাখা হয়নি। গোছাতে নিয়ে আজকে
স্কুল যেতে দেরী হয়ে যাচ্ছে তাই ওকে বললাম ,বাবা ,এইজন্যেই মা সবকিছু
রাতেই গুছিয়ে রাখি। তাহলে সকালে আর হুলুস্থুল হয়না। ছেলে আমাকে উত্তর দেয়
:মা ,তাহলে কি দাঁত ব্রাশ টাও রাতে একবার করে রাখলেই হবে ?"
মানুষতো মাটি দিয়ে তৈরী তাইনা মা ?
হ্যা বাবা।
মানুষ যখন মরে যায় তখন তো তাকে কবর দেয়া হয় মাটিতে। তাহলে মানুষ কবরে গিয়ে আবার মাটি হয়ে যায়। তাইনা মা ?
হ্যা বাবা।
তাহলেতো মা ,আম্মা আর কোনোদিন তোমার কাছে ফিরে আসতে পারবেনা মা ,এতদিনে আম্মা তো তাহলে মাটি হয়ে গেছে। তুমি তাহলে কেনো আম্মার জন্যে অপেক্ষা কর মা ?
আচ্ছা বাবা ,আমি মরে গেলে তুই কি করবি ?কবরে দিয়ে আর অপেক্ষা করবিনা তাইনা ?
একটু হেসে রোদ্দুর :মা ,তুমি মরে গেলে আমিওতো মরেই যাব মা।
মানুষদের তো বিয়ে করতেই হয় তাইনা মা ?
হুম।
আর বিয়ে হয়ে গেলে মেয়েদের তো শশুরবাড়ি তে থাকতেই হয় তাইনা মা ?
হুম।কেনো ?কি সমস্যা ?
তোমাকে নিয়ে খুব টেনশন হচ্ছে ।বিয়ে হয়ে গেলে তুমি কোথায় থাকবে মা ?